ডারউইনের বীগল ও প্রাকৃতিক নির্বাচন

You are currently viewing ডারউইনের বীগল ও প্রাকৃতিক নির্বাচন

ডারউইনের বীগল ও প্রাকৃতিক নির্বাচন:

বৃটিশ নেভির ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিটজ্ রয় ডারউইনের ওমন বোঁচা নাক দেখে বললেন-এরকম কাজ করার জন্য যে উদ্যম আর সংকল্প থাকার দরকার তা এর থাকতে পারে না। একে দিয়ে কোন কাজ হবে না। পরে অবশ্য ক্যাপ্টেন ভুল বুঝতে পারেন তার গোড়ামির ব্যাপারে।  ১৮০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডে যখন চার্লস ডারউইন জন্ম গ্রহণ করেন ঠিক একই দিনে আমেরিকায় আর একজন বিখ্যাত লোক জন্ম গ্রহণ করেন-তাঁর নাম আব্রাহাম লিংকন। ডারউইনের বাবা এবং দাদা দুজনই ছিলেন ডাক্তার সেজন্য সবাই আশা করেছিলেন ডারউইনও ডাক্তার হবেন। কিন্তু বার বছরের ডারউইনের ইচ্ছেই ছিলো কেবল বাইরে ঘুরাঘুরি করা এবং প্রকৃতির সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার।  সারাদিন টো টো করে বনে বাদারে ঘুরে বেড়াত, পড়ালেখায় কোন মনোযোগ ছিলো না। বিভিন্ন গাছপালা, জীবজন্তুর নমুনা সংগ্রহ করা, তাদের আচরণ লক্ষ্য করা নিয়ে পড়ে থাকত সবসময়। স্কুল বোর্ডিং এর বদ্ধ জীবন তাঁর কাছে অতিষ্ঠ মনে হতো।  

ডারউইনের বাবা একদিন তো রেগেমেগে ছেলেকে কড়া ভাষায় চিঠি লিখলেনঃ তুমি এসব কুকুর, বিড়াল,  ইঁদুর, শিকার করা নিয়ে অতী আগ্রহী, পড়ালেখায় তোমার কোন মন নাই, তুমি তোমার নিজের আর পরিবারের মুখে কালি দিবে এ আমি দেখতে পাচ্ছি। 

ডারউইনকে ১৬ বছর বয়সে ডাক্তারি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে তাঁর মোটেই উৎসাহ নেই বরং বন্ধুদের সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আনন্দ বেশি।  সমুদ্র থেকে নানা প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখতেন। কেমব্রিজের প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সমিতিতে নিয়মিত যোগ দিতেন। পরে তাকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয় পাদরি বানাবার জন্য। সেখানে পড়ালেখা করতে থাকলেন কিন্তু আগের ঝোঁক গেল না মাথা থেকে।  পরীক্ষায় পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা কাজ পেয়ে গেলেন পাদরি হিসেবে নয়, একটা জাহাজে অবৈতনিক প্রকৃতিবিদ হিসেবে। জাহাজটির নাম হল H. M. S. Beagle(Her Majestic Service Beagle) যার ক্যাপ্টেন ছিলেন Robert Fitz Roy বৃটিশ নেভি। সেসময় জাহাজটি সমুদ্র সফরে বের হচ্ছিল যার উদ্দেশ্য ছিলো ইংরেজদের জন্য নানা দেশে যাওয়ার রাস্তা বের করা আর বাণিজ্য সুবিধা সন্ধান করা। ১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ডেভনপোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করে এ জাহাজটি যাতে চড়ে বসেন এক মহান চিন্তাবিদ ও প্রকৃতিবিদ। 

ডারউইনের বীগল ও প্রাকৃতিক নির্বাচন
এইচ. এম. এস. বীগল

মাত্র ২২ বছর বয়সে এরকম এক দুঃসাহসিক অভিযানে বের হয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর মাত্র ৯০ ফিটের একটি জাহাজে কাটিয়ে তিনি যে জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন তা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের চিন্তার জগতকে আলোড়িত করেছিলো।  এই অভিযানেই তিনি বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল ভিত্তি খুঁজে পান। এক দেশ থেকে আর এক দেশ, এক সাগর থেকে আর এক সাগর, এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপ, এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশ ভ্রমণ করতে থাকেন। যেখানেই যান সেখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করতে থাকেন নানারকম গাছপালা, পাথর,  জীবজন্তুর হাড়, ফসিল ইত্যাদি। তিনি এগুলো পর্যবেক্ষণ করেন আর খাতায় লিখে রাখেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করতে করতে তার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জীবজগতের রহস্য। তিনি বিভিন্ন রকম জাতের জীবজন্তুর মধ্যে নানান আশ্চর্য্য মিল দেখতে পারেন। ঘুরতে ঘুরতে তিন বছর পর বীগল দক্ষিণ আমেরিকার দ্বীপ গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জে এসে নোঙর করল। 

গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জ
গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জ

ডারউইন দেখলেন, দ্বীপগুলোর ওপরকার গাছপালা আর জীবজন্তুর অনেকটা আসল মহাদেশের ওপরকার গাছপালা, জীবজন্তুর মতই কিন্তু তাদের বেশিরভাগই পৃথক জাতের। আবার এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপেও এদের মধ্যে যথেষ্ট তফাত রয়েছে। তিনি আরও দেখলেন গ্যালাপোগাসের এক দ্বীপের পাখি আর এক দ্বীপের পাখির মতো প্রায় একরকমের হলেও সম্পূর্ণ এক নয়৷ তাদের রঙে,  তাদের গানে, তাদের বাসা বানানোর কায়দায়, তাদের ডিমে নানান ধরনের খুঁটিনাটি তফাত রয়েছে। তিনি সেখান থেকে ২৩ রকমের পাখি সংগ্রহ করলেন যার একটাও মহাদেশের ওপরে দেখা যায় না৷ 

গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন ফিঙে
গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন ফিঙে

বিশেষ করে চোখে পড়ল তাঁর বিভিন্ন দ্বীপে বিভিন্ন রকমের ফিঙে। কোনোটার ঠোঁট সরু, কোনটার মোটা,  কোনটার বাঁকা। কেউ খায় ছোট বীজ, কেউ বড় বীজ, আবার কেউ বা বাঁচে পোকামাকড় খেয়ে। তিনি ১৪ জাতের ফিঙে খুঁজে পেলেন দ্বীপগুলোতে। এর একটাও মূল মহাদেশে দেখতে পাওয়া যায় না৷  তিনি মনে করলেন নিশ্চয়ই সুদূর অতীতে মূল মহাদেশ থেকে দু-একটা ফিঙে এসব দ্বীপে এসেছিল তারপর বিভিন্ন রকম পরিবেশে পড়ে তাদের মধ্যে নানান রকম পরিবর্তন দেখা যায়। নানান রকম খাদ্যাভ্যাস আর জীবনযাত্রার ফলে ক্রমে ক্রমে তাদের গড়ন বদলে যেতে থাকে,  তৈরি হয় নানান রকমের ঠোঁট- আলাদা আলাদা জাত।

ডারউইন আরও লক্ষ্য করলেন সেখানে বিরাট বিরাট রাক্ষুসে কাছিম আছে- তার এক-একটা জাত এত বড় যে ঝুলিয়ে নিতে হলে আটজন লোকের দরকার হয়। 

বিরাটাকার কাছিম
বিরাটাকার কাছিম

মজার বিষয় হলো এসব দ্বীপের লোকজন কাছিমের চেহারা দেখেই বলে দিতে পারে কোনটা কোন দ্বীপের। এসব গড়মিলের নিশ্চয়ই কোন মানে আছে। মূল মহাদেশ থেকে দু-একটি পূর্ব-পুরুষ এসব দ্বীপে গিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জ মূল মহাদেশ থেকে দূরে বলেই প্রকৃতির এই পরীক্ষাশালায় মানুষের অগোচরে ঘটেছে বিচিত্র সব জাতের সমাবেশ। বীগল এই দুর্গম,  রুক্ষ দ্বীপে কাটিয়েছিলো মাত্র পাঁচ সপ্তাহ কিন্তু ডারউইন বলেছেন এটাই তার জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় কাল। 

বিলেতে ফিরে তিনি ধারণাগুলি জড়ো করে নোট লিখলেন দীর্ঘ  বিশ বছর ধরে। এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি লিখলেনঃ সবরকমের জীবদেহ—সে গাছই হোক আর জন্তুই হোক—সাধারণ পূর্ব-পুরুষ থেকে জন্মেছে। এক জাত থেকে বংশে বংশে বদলে কী করে একবারে অন্য জাতের সৃষ্টি হয় তাও ডারউইন প্রমাণ করলেন। কী বললেন তিনি? 

ধরা যাক, একটা প্রাণীর কথা।  একই প্রাণীর সন্তান-সন্ততির মধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক ব্যতিক্রম থাকেই।  যেসব ব্যতিক্রম তাকে পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করতে সাহায্য করে সেগুলো বংশধরদের মধ্যে টিকে যায়।  বাকিগুলো টেকে না, বিলুপ্ত হয়ে যায়। আজকের মতো লম্বা গলাওয়াল জিরাফ চিরকাল ছিলো না। জিরাফের মধ্যে কারও কারও হয়তো ছিলো কিছুটা লম্বা গলা। তারা বনে-জঙ্গলে গাছের ওপর থেকে বেশি পাতা খেয়ে শক্ত-সমর্থ হলো বেশি, কাজেই বেশি বংশধরও রেখে গেল। তাদের বংশধররাও কিছুটা পেল বাপ-মায়ের লম্বা গলার আদল। এমনি করে ধীরে ধীরে লম্বা গলাওয়ালা জিরাফের সংখ্যা বাড়তে থাকল। যাদের খাটো গলা তারা পাতা খেতে পেল কম,  তাই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমে ক্রমে তাদের সংখ্যা কমতে লাগল। ডারউইন এটাকেই বলছেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন। 

অর্থাৎ চুড়ান্ত পর্যায়ে প্রকৃতিই নির্বাচন করে থাকে কারা টিকে থাকতে সমর্থ বা অসমর্থ। নতুন প্রজাতি সৃষ্টিতে তাঁর গ্রহণযোগ্য মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো হলো-

(ক) বংশবৃদ্ধির উচ্চহার( Prodigality of production)

(খ) খাদ্য ও বাসস্থানের সীমাবদ্ধতা(Limitation of food and space)

(গ) জীবন সংগ্রাম(Struggle for existence)   

(ঘ) পরিবৃত্তির অসীম ক্ষমতা(Omnipotence of variation amongst individual)

(ঙ) যোগ্যতমের জয়(Survival of the fittest)

(চ) প্রাকৃতিক নির্বাচন(Natural selection)          

এ-ধরনের ক্রমবিকাশ শুধু যে প্রকৃতিতে আপনা-আপনি হয় তা নয়।  মানুষ প্রয়োজনমতো এই পরিবর্তনের ধারাকে কাজে লাগাতে পারে। এই ক্রমবিকাশের ধরাকে কাজে লাগিয়েই মানুষ উদ্ভাবন করেছে এমন জাতের পোষা গরু যার দুধ, মাংস বেশি হয়। এমন জাতের ঘোড়া যা আকারে বড় হয় আর জোরে ছুটতে পারে৷ 

তিনি বিপুল পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এই মতবাদকে সকলের সামনে তুলে ধরলেন।  এটি কী করে হয় এবং কেন হয় তাও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ১৮৪৪ সালে তিনি তাঁর ধারণাগুলো বই আকারে লেখা শুরু করেন। আঁটসাঁট যুক্তির বাঁধুনি দিতে পনের বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৮৫৯ সালে যুগান্তকারী সেই বই “On the Origin of Species By Means of Natural Selection” (বইটি এই লিংক থেকে ডাউনলোড করা যাবে) বের করেন যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ ও প্রমাণসহ। ১৮৮২ সালে ডারউইনের মৃত্যু হলে তাঁকে রাজকীয় সম্মানে নিউটনের পাশে সমাহিত করা হয়।    

 

উৎপল কুমার

 

 

 

তথ্যসূত্র-

১। আবিষ্কারের নেশায়- আবদুল্লাহ আল-মুতী

২। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা

৩। লুমেন লার্নিং

Leave a Reply