আমরা নিজেদেরকে যেমন সামাজিক জীব বলে দাবি করি ঠিক তেমনি মৌমাছিও সামাজিক জীব। তবে পার্থক্য হলো আমরা যেমন অরাজক ও বিশৃঙ্খল তার পরিবর্তে তাদের মধ্যে প্রকৃত সামাজিকতা(Eusociality) দেখা যায় এবং যাদের অধিকাংশ সদস্য অনুর্বর। এরা নিজের প্রজননিক কথা চিন্তা না করে সময়, শ্রম এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। যাকে আমরা বলছি পরার্থপরতা(Altruism)। সামাজিক সুশৃঙ্খলা রক্ষার এক অনন্য উদাহরণ মৌমাছিদের জীবন। মাতৃতান্ত্রিক তথা একটি রাণী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রায় লক্ষাধিক মৌমাছির সমাজ আমাদের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একটি মৌচাকে কাজের ভিত্তিতে তিন ধরণের মৌমাছি থাকে।
(১) একটি রাণী মৌমাছি যা একমাত্র উর্বর
(২) কয়েকশত ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি এবং
(৩) ১০-৮০ হাজার বা লক্ষাধিক কর্মী মৌমাছি।
রাণী মৌমাছিই একটি কলোনির প্রধান এবং তার উপর নির্ভর করে ঐ কলোনির বংশবৃদ্ধি, ক্ষমতা, শ্রমবন্টন ইত্যাদি। ডিম পাড়ার আগে রাণী মৌমাছি সঙ্গম উড্ডয়নে(Nuptial Flight) অংশগ্রহণ করে কলোনির ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছিদের সাথে যৌন মিলনের জন্য। এসময় সে ১০-২৫ টি ড্রোনের স্পার্ম বা শুক্রাণু সংগ্রহ করে এবং তার স্পার্মাথিকাতে কয়েক বছরের জন্য এই স্পার্ম জমা করে রাখে। তারপর সে দিনে প্রায় ২০০০ হাজার ডিম পাড়ে এবং নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সেগুলোকে নিষিক্ত করতে থাকে। এই নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয় নারী বা কর্মী মৌমাছি এবং অনিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয় ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি। তার মানে সকলেরই মাতা হচ্ছে সেই রাণী কিন্তু নারী সদস্যদের পিতা থাকে ভিন্ন ভিন্ন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরুষ বা ড্রোনদের বাপ থাকেনা কিন্তু নানা থাকে ; পুত্র থাকে না কিন্তু কন্যা, নাতি-নাতনি থাকে। যেভাবে এই লিঙ্গ নির্ধারণের বিষয়টি ঘটে তাকে বলা হচ্ছে হ্যাপ্লডিপ্লয়ডি। এটি Hymenoptera বর্গের প্রাণীদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেখানে পুরুষ মৌমাছি হচ্ছে অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে এবং এরা হ্যাপ্লয়েড। অপরপক্ষে নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে হচ্ছে নারী মৌমাছি এবং এরা ডিপ্লয়েড। অনেক সময় হ্যাপ্লডিপ্লয়ডিকে বলা হয় আরহেনোটকি(Arrhenotoky) [গ্রীক, arrhen=male person + toky= birth of] বা আরহেনোটকাস পার্থেনোজেনেসিস- যেখানে অনিষিক্ত ডিম্বাণু হতে পুরুষ সদস্যের জন্ম হয়(মৌমাছির ক্ষেত্রে)। চিত্রের মাধ্যমে দেখলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এই লিঙ্গ নির্ধারণের পদ্ধতিটি হয়ে থাকে একটি বংশধর কর্তৃক কয়টি ক্রোমোজোম গৃহীত হলো তার উপর। আমরা মানুষ যেমন ৪৬ টি ক্রোমোজোম বহন করি। ২৩ টি মাতা থেকে এবং ২৩টি পিতা থেকে যার ফলাফল হলাম আমরা এবং আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য। একই রকম ঘটনা ঘটে মৌমাছিদের ক্ষেত্রেও তবে শুধুমাত্র নারী মৌমাছির ক্ষেত্রে। যে ডিম্বাণুটি নিষিক্ত হয় সেখানে মাতা থেকে ১৬টি এবং পিতা থেকে ১৬ টি ক্রোমোজোম থাকে অর্থাৎ তারা হয় ডিপ্লয়েড। অন্যদিকে অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে পার্থেনোজেনেসিস পদ্ধতিতে যে পুরুষ বংশধরের জন্ম হয় সেখানে থাকে শুধু ১৬ টি ক্রোমোজোম তাই এরা হ্যাপ্লয়েড।
১৬টি ক্রোমোজোম রাণী মৌমাছির + ১৬ টি ক্রোমোজোম ড্রোনের শুক্রাণু থেকে= নারী মৌমাছি(কর্মী/রাণী) এবং এরা ডিপ্লয়েড।
১৬টি ক্রোমোজোম রাণী মৌমাছির + ০০(শূন্য) ক্রোমোজোম ড্রোনের শুক্রাণু থেকে= পুরুষ বা ড্রোন এবং এরা হ্যাপ্লয়েড।
তার মানে দেখা যাচ্ছে এইসব ড্রোনের মাতা একজন কিন্তু কোন পিতা নাই। তবে তাদের নানা আছে কারন তাদের মাতার জন্ম হয়েছে নানার শুক্রাণু থেকে। তেমনি ড্রোনের কন্যা এবং নাতি-নাতনি থাকবে কারন সে রাণীর সাথে সঙ্গমের পর তাদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে নারী মৌমাছির তথা কন্যার জন্ম হবে কিন্তু পুরুষ মৌমাছি হবে অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে তাই তার পুত্র থাকবেনা।